বাল্য বিবাহ একটি সামাজিক অন্যায় একে প্রতিহত করুন, এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন। সামাজের ক্ষতিকর আচারগুলো বদলে দিতে হবে আমাদের সচেতনতার মাধ্যমেই। বিশ্বে বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যতম।

বাল্য বিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এটিই সময়। বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ একটি মারাত্মক সমস্যা৷ ইউনিসেফের শিশু ও নারী বিষয়ক প্রতিবেদনে অনুসারে বাংলাদেশের ৬৪% নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে৷ বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে, ছেলেদের বিবাহের বয়স নুন্যতম ২১ বছর এবং মেয়েদের বয়স ১৮ হওয়া বাধ্যতামূলক৷ অশিক্ষা, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক নানা কুসংস্কারের কারনে এ আইনের তোয়াক্কা না করে বাল্য বিবাহ হয়ে আসছে৷

বাল্য বিবাহের প্রধান কুফল: নারী শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া ছাড়াও বাল্য বিবাহের কারনে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন মা মারা যাচ্ছেন৷ অন্যদিকে প্রতি ঘন্টায় মারা যাচ্ছে একজন নবজাতক৷ নবজাতক বেঁচে থাকলেও অনেক সময় তাকে নানা শারীরিক ও মানষিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়৷ অপ্রাপ্তবয়স্ক মা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করতে পারে৷ এছাড়া এতে গর্ভপাতের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়৷ বাল্য বিবাহের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের আশংকা তৈরী হওয়া ছাড়াও নানা পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয়৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উপায়ঃ বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনটি বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রচার/প্রচারনা করা প্রয়োজন৷ রেডিও, টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করা যেতে পারে৷ গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বিবাহ বন্ধসহ মামলা রজ্জু করা যেতে পারে৷ জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোন অবস্তুায়ই নিকাহ রেজিষ্টার যেন বিবাহ নিবন্ধন না করেন, সেরূপ আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে৷ প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে৷ নবম ও দশম শ্রেনীর পাঠ্য বইতে এ বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করা হলে এর সুফল পাওয়া যাবে৷ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বেসরকারী সংস্তুাগুলোও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে৷

চ্যালেঞ্জ:

  • শিশু বিবাহ আমাদের সমাজের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রথা যা নারীদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক মূল্যবোধ ও অসম অবস্থানেরই প্রতিফলন।
  • বাংলাদেশে নারীদের সবসময়ই আর্থিক বোঝা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যদিও শিশু বিবাহ বিগত ৩০ বছরে ধীরে ধীরে হলেও হ্রাস পেয়েছে।
  • দারিদ্র ও অশীক্ষা এক্ষেত্রে নির্ধারণী বিষয়, কিন্তু দলিল ও প্রমাণাদি বলে যে, সকল পটভূমি ও সামাজিক বিভাজনের মধ্যে বাল্যবিবাহ চর্চা করা হয়।
  • ৫০ শতাংশের অধিক বাংলাদেশি নারী যাদের বয়স এখন ২০ এর মাঝামাঝি তাদের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে হয়েছে। প্রায় ১৮% বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের নিচে।   
  • দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মূল প্রভাব বিস্তার করে।
  • পরিবারের সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা তাঁদের মনের ইচ্ছা বিসর্জন দেয়। এদেশে সাধারণত বোঝা হয়ে দাঁড়ায় মেয়েরা যখন তাঁদের বিয়ে দিতে অভিভাবকের চিন্তা করতে হয়। একজন মেয়ে শিশু যখন যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তাদের পিতা-মাতা তখন তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে।
  • বাল্যবিবাহ রোধ করার ক্ষেত্রে এটিই হলো মূল বাধাঁ। কারন, সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যেসব পিতা-মাতা মেয়ে শিশুদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, তারা মেয়ে শিশুর বয়ঃসন্ধির শুরুতে যৌন নির্যাতনের ভয় অনুভব করে। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এই উদ্বেগের কারণ। 
  • অনেক বিবাহিত কিশোরী দৈহিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বা এসবের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। এসব কিশোরী মেয়েদের মধ্যে ৩৩% বিশ্বাস করে যে, একজন স্বামীর তার স্ত্রীকে আঘাত করা যৌক্তিক।
  • বিবাহের বাইরে যৌন কার্যকলাপ শুরু করার ব্যাপারে মেয়েদের উপলব্ধিকে সামাজিক মূল্যবোধের/নিয়মকানুনের জন্য হুমকি হিসাবে দেখা হয়। ’পবিত্রতা’ ও ’সম্মান’- এ দুয়ের মধ্যে আপসের উপলদ্ধি থেকে তাদেরকে ’কলঙ্কিনী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।   
  • যদিও, শিশুদের বিয়ে দেয়া এক ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ বিশ্বাস করে না। এ কারনে, যেসব কিশোরী মেয়েদের বিয়ে হয়, তারা আগাম গর্ভবতী হওয়া ও নেতিবাচক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। 
  • জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের বাল্যবিবাহ ও পাচারের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
  • এরূপ নিয়মকানুন/মূল্যবোধ, অবশেষে শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েদের, বেঁচে থাকার বিকাশ, সুরক্ষা এবং অংশগ্রহণের বিষয়ে আপোষ করার ব্যাপারটিই প্রমান করে।

সমাধান:

  • সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়সকে বিলম্বিত করার সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
  • বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং প্রতিটি পর্যায়ে মূল নীতি-নির্ধারক এবং অংশীজনদের যুক্ত করা।
  • সকল উন্নয়ন সহযোগীদের কারিগরী সহযোগিতায় নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে সরকারের মাধ্যমে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা (ন্যাশন্যাল প্ল্যান অফ এ্যাকশান) প্রস্তুত করা। মেয়ে শিশুদের বেড়ে উঠা ও উন্নতিলাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করা।
  • অ্যাডভোকেসি পর্যায়ে, বাল্যবিবাহের বিষয়টিকে ধীরে ধীরে মূলধারার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা এবং দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির সাথে একীভূত করা।
  • সম্প্রদায় পর্যায়ে কিশোরী, পিতা-মাতা এবং বিশেষ করে বাবা, যারা বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সাথে সার্বক্ষণিক আলোচনা করা।
  • শিশুদের বর্ধিত পরিবার এবং সম্প্রদায়ে তাদের কেয়ারগিভার, স্থানীয় ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং সরকারি প্রতিনিধি ও সামনের সারির কর্মীদের নিকট পৌঁছানো।
  • মানুষের সাথে জড়িত হবার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনমূলক থিয়েটার, সম্প্রদায়ভিত্তিক আলোচনা, উঠান বৈঠক, রেডিও ও টিভি নাটকের সিরিয়াল এবং কোনো অনুষ্ঠানের মধ্যে ফোনে আলাপ করা, সম্প্রদায়ভিত্তিক ঘোষণা এবং অন্যান্য বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করা।
  • এছাড়াও সচেতনতা সৃষ্টি ও দক্ষতা বৃদ্ধি, বৃত্তির মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, এবং মেয়েদের দরকষাকষি করা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা এবং এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার ব্যাপারে আরো প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাওয়া।
  • শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কাজ করা যাতে করে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক থেকে মেয়েদের রক্ষা করার আইনগুলো প্রয়োগ করা যায়।
  • মৌলিক সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা। যেমন, মাসিক স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা ছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা।
  • সৃজনশীলতা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারণা।

শেষ কথা: সরকারের দিন বদলের অঙ্গীকার রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হবে৷ ২০২১ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩.৮ থেকে কমিয়ে ১.৫ করা হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা না গেলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না৷ বাল্য বিবাহ সংকুচিত করে দেয় কন্যা শিশুর পৃথিবী৷ আমরা যদি সবাই সচেতন হই তাহলে কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে৷ দেশে মা ও শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে৷ তাই বাল্য বিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ এখন থেকেই৷

শিশুদের বিবাহ এক ধরনের যৌন নির্যাতন, এ বিষয়টি এখনও বিশ্বাস করেনা বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ।

তথ্যসুত্র: চাইল্ড ম্যারিজ রেজট্রেইন্ট অ্যাক্ট, ২০১৭ ||  ইউনিসেফ